১০ মিনিটের নৃশংসতা ঝটিকা অভিযানে হাজার হাজার তৌহিদী জনতা নিহত ও অসংখ্য আহত দাবি হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপি’র
অসংখ্য
গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে নৃশংস, বর্বর ও ইতিহাসের জঘন্যতম
হামলা চালানো হয় হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে
ইনকিলাব
রিপোর্ট : রাজধানী মতিঝিলের শাপলা চত্বরকে ঘিরে হেফাজতে ইসলামের
শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে মধ্যরাতে ঝটিকা অভিযান চালায় র্যাব, পুলিশ ও
বিজিবি’র ১৫ থেকে ২০ হাজার সদস্য। দৈনিক বাংলা ও ফকিরাপুল মোড়সহ তিন দিক
থেকে অপারেশন শুরু করা হয়। পরে একযোগে অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে অসংখ্য গুলি,
টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে নৃশংস, বর্বর ও ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা
চালানো হয়। তখন ইত্তেফাক মোড় ঘিরে রাখে র্যাবের শত শত সদস্য। অভিযানের সময়
সশস্ত্র অপারেশনের আওয়াজে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা।
রাত আড়াইটা থেকে শুরু হওয়া এই যৌথ অভিযানে ১০ মিনিটের মধ্যেই হেফাজত
ইসলামের প্রায় এক লাখ নেতা-কর্মীকে মতিঝিল থেকে হটিয়ে দেয়া হয়। এ সময় তারা
যাত্রাবাড়ি ও ডেমরার দিকে চলে যান। ঝটিকা অভিযানে হাজার হাজার তৌহিদী জনতা
নিহত ও অসংখ্য আহত হয়েছেন বলে বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা দাবি
করেছেন। অভিযানের পর পরই আন্তর্জাতিক মিডিয়াসহ বিভিন্ন ওয়েব সাইটে অভিযানের
বিভিন্ন ধরনের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন ওয়েব সাইটে শত শত লাশের ছবি
দেখা গেছে। পুলিশ কন্ট্রোল রুমে বসে পুরো অভিযান পর্যবেক্ষণ করেন
আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা। নৃশংস এ অভিযানের
নেতৃত্বে ছিলেন র্যাবের গোয়েন্দা ইউনিটের প্রধান লেঃ কর্নেল জিয়া, ঢাকা
মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মারুফ হাসান ও অতিরিক্ত
পুলিশ কমিশনার (অর্থ) আব্দুল জলিল মন্ডল। অভিযানের সময় এপিসি (আর্মার্ড
পার্সোন্যাল কেরিয়ার) থেকেও শত শত রাউন্ড গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়া হয়।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট শামসুল হক টুকু সাংবাদিকদের বলেন,
বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে। সরকার মনে করছে, এ
মুহূর্তে কোনো সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে
পারে। সে জন্যই মধ্যরাত পর্যন্ত সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সরকারের প্রতিটি বাহিনী পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। কোথাও কোনো ধরনের ঘটনা
ঘটলে তারা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেবে।
হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর
প্রচার সেল প্রধান মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াছেল বলেন, মতিঝিলের শাপলা চত্বরকে
ঘিরে হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে মধ্য রাতে নিরীহ জনতার উপর
বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে হাজার হাজার
জনতার প্রাণ কেড়ে নেয়া হয়েছে। তারা শহীদ হয়েছেন। ২০ সহস্্রাধিক মানুষকে
পঙ্গু করেছে। তা ইতিহাসে কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বিএনপি’র
ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা সাংবাদিকদের বলেন, মতিঝিলে রোববার রাতে
অবস্থান নেয়া হেফাজতে ইসলামের ‘সহস্রাধিক’ নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন এবং
তাঁদের শত শত লাশ গুম করা হয়েছে। খোকার দাবি, হেফাজতে ইসলামের শান্তিপূর্ণ
কর্মসূচিতে সরকার মধ্যরাতে হামলা চালিয়েছে। এটিকে তিনি ‘গণহত্যা’ হিসেবে
উল্লেখ করেন।
সূত্র জানায়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা রোববার দিবাগত
রাত ১২টা থেকেই সতর্ক ও সশস্ত্র অবস্থান গ্রহণ করেন। চরম অভিযানে শীর্ষ
কর্মকর্তাদের নির্দেশের অপেক্ষায় ছিলেন তারা। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই তারা
অ্যাকশনে নামেন। অভিযানে পুলিশের পাশাপাশি অংশ নেয় বিপুল সংখ্যক র্যাব ও
বিজিবি সদস্য। পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) মারুফ হাসান
অভিযানের পূর্বে ডিএমপি অ্যাক্টের কোন ধারা অনুযায়ী এবং কিভাবে অভিযান
পরিচালিত হবে, কোন কোন ধরনের অস্ত্র এবং যানবাহন ও সামগ্রী ব্যবহার করা হবে
এ ব্যাপারে যৌথ বাহিনীকে সংক্ষিপ্ত ব্রিফিং করেন। সে অনুযায়ী অভিযানে
রাবার বুলেট, বুলেট, টিয়ার গ্যাস শেল, পিপার গান এবং সাউন্ড গ্রেনেড
ব্যবহার করার কথা। কিন্তু অভিযানের শুরুর পরপরই দেখা যায়, আইন-শৃঙ্খলা
বাহিনীর সদস্যরা তাদের সাথে থাকা চাইনীজ রাইফেল এবং একে-৪৭ এর মতো অটোমেটিক
রাইফেল দিয়েও মুহুর্মুহু গুলিবর্ষণ করছে। আর এর ফলেই হতাহতের সংখ্যা
মুহূর্তেই হাজার ছাড়িয়ে যায়।
গতকাল সকালে ফকিরাপুল পেট্রোল পাম্পের
বিপরীতের এক আবাসিক হোটেলের ম্যানেজার নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান,
তিনি সারা রাত তার ভবনের ছাদে বসে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত খেদাও অভিযান
প্রত্যক্ষ করছিলেন। অভিযানের পরপরই তিনি ট্রাকে করে নীল পলিথিনে ঢেকে
ট্রাকভর্তি লাশ নিয়ে যেতে দেখেছেন। অনেকেই গোপনে এসব দৃশ্য ভিডিও করেছ্নে।
অভিযানের সময় আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সিভিল পোশাকে বেশ কিছু
লোকজন অংশ গ্রহণ করে। তারা আহত হেফাজত কর্মীদের উপর নির্মম নির্যাতন চালায়
বলে প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, টানা
অবস্থানের ঘোষণা দেয়া হেফাজতে ইসলামের কর্মীদের গভীর রাতে ১০ মিনিটের ঝটিকা
অভিযানে মতিঝিল থেকে উৎখাত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত ৫ মে রোববার দিনভর
সংঘাতে ১৬জন নিহত হওয়ার পর রাত আড়াইটার দিকে মতিঝিলে ঝটিকা অভিযান শুরু
করে র্যাব, বিজিবি ও পুলিশ। মূল অপারেশনের আগেই ওই এলাকার ডিস লাইন ও
বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন করা হয়। দৈনিক বাংলা ও ফকিরাপুল মোড় থেকে এক যোগে
অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে অসংখ্য গুলি, টিয়ার শেল ও সাউন্ড গ্রেনেড নিয়ে
নৃশংস, বর্বর ও ইতিহাসের জঘন্যতম হামলা চালানো হয়। তখন ইত্তেফাক মোড় ঘিরে
রাখে র্যাবের শত শত সদস্য। অভিযানের সময় সশস্ত্র অপারেশনের আওয়াজে
প্রকম্পিত হয়ে ওঠে মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা। কাঁদানে গ্যাস ও বুলেটে
টিকতে না পেরে বিভিন্ন গলিতে ঢুকে পড়েন মতিঝিলে অবস্থানকারীরা।
রাত
আড়াইটায় র্যাব, বিজিবি ও পুলিশের যৌথ ঝটিকা অভিযানের আগে পুলিশ ও র্যাবের
কর্মকর্তারা হ্যান্ডমাইকে হেফাজতকর্মীদের মতিঝিল ছেড়ে যাওয়ার আহ্বান
জানান। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যান করে অবস্থানকারীরা। ১৫ থেকে ২০ হাজার
র্যাব, বিজিবি ও পুলিশ সদস্য যখন অভিযান শুরু করেন, তখনো প্রায় এক লাখ
কর্মীর উপস্থিতিতে সমাবেশ মঞ্চ থেকে বিভিন্ন সেøাগান দেয়া হচ্ছিল, চলছিলো
বক্তব্যও। ফকিরাপুল হয়ে নটরডেম কলেজ ও দৈনিক বাংলা থেকে র্যাব, বিজিবি ও
পুলিশ একযোগে অভিযান শুরু করে ১০ মিনিটের মধ্যে মতিঝিলে শাপলা চত্বরের
নিয়ন্ত্রণ নেয়। তখন ট্রাকের ওপর নির্মিত অস্থায়ী সমাবেশ মঞ্চে হেফাজতের
কোনো নেতাকে দেখা যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী হাসান জানান, ঝটিকা অভিযানে অংশ
গ্রহণকারীরা বৃষ্টির মতো গুলি চালায়। গুলি, টিয়ার গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড
নিয়ে নৃশংস হামলায় নিরস্ত্র হেফাজতে ইসলামের নেতা-কর্মীরা টিকতে না পেরে এক
পর্যায়ে আর কে মিশন রোডের চৌরাস্তা দিয়ে গোপিবাগ ও টিকাটুলির মোড় দিয়ে
ডেমরার দিকে চলে যায়। তখন ইত্তেফাক মোড়ে সশস্ত্র র্যাব-বিজিবি অবস্থান
করায় কেউ সামনে এগোতে পারেনি। র্যাব, পুলিশ ও বিজিবির নির্মম সশস্ত্র
হামলার সময় হেফাজত ইসলামের নেত্-াকর্মীরা ইট পাটকেল ছুড়ে মোকাবেলার চেষ্টা
করেন। কিন্তু আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে তারা টিকতে পারেননি। ঝটিকা অভিযানের সময়
অসংখ্য হেফাজত কর্মীকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ঝটিকা
অভিযানে অংশ নেয়া আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর দু’জন সদস্য দৈনিক
ইনকিলাবকে বলেন, ঝটিকা অভিযানের আগেই বিপুল সংখ্যক ট্রাক আনা হয়। তাছাড়া
অভিযানের পর দ্রুত এলাকা পরিষ্কার করার জন্য সিটি কর্পোরেশনের লোকজনকে
অপেক্ষমাণ রাখা হয়। অভিযানের পর পরই তারা মতিঝিল এলাকায় পরিষ্কারের জন্য
মাঠে নামেন। প্রাথমিকভাবে অভিযানের বিভিন্ন ধরনের আলামত এবং হতাহতদের রক্তও
পরিষ্কার করা হয়। হেফাজতকর্মীরা চলে যাওয়ার পর মতিঝিলের সড়কে অসংখ্য কাগজ,
স্যান্ডেল এবং কিছু ব্যাগ পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিভিন্ন স্থানে স্তূপ করে
রাখা কাগজে আগুনও জ্বলছিল। পুড়িয়ে দেয়া পাঁচটি গাড়িও দেখা যায় সড়কের পাশে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ঠেকাতে সড়ক বিভাজকের স্টিলের বেড়া ভেঙে সড়কের
ওপর আড়াআড়ি করে রেখেছিল হেফাজতকর্মীরা। সেখান থেকে ইট খুলেও তারা টুকরো
টুকরো করে রাখে, যা পুলিশের দিকে ছোড়া হয়।
গতকাল ভোর রাতে হেফাজত ইসলামে
বেশ কয়েকজন কর্মী জানান, র্যাব-পুলিশের অভিযানের মুখে মুহূর্তেই ফাঁকা
হয়ে গেল মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকা। কয়েক স্তরের মানব ঢাল দিয়ে নিরাপত্তা
ব্যুহ তৈরি করেও টিকতে পারলো না শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়া হেফাজতে ইসলামের
কর্মীরা। মূলত: আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মোকাবেলায় এই ব্যুহ তৈরি করেছিল তারা।
এর আগে র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল জিয়াউর আহসান হেফাজতের
কর্মীদের শাপলা চত্বর ছাড়ার নির্দেশনা দেন। এ নিয়ে হেফাজতের নেতাদের সঙ্গে
তার কথাও হয়। মাইকিং করে সতর্ক করা হয়। এরপর টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ,
লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট ও অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করে সরিয়ে
দেয়া হয় হেফাজতের কর্মীদের। এ সময় হাজার হাজার নেতা-কর্মী নিহত ও অসংখ্য
আহত হয়েছে বলে তাদের দাবি।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন